নীরব কিন্তু চৌকস রাজনৈতিক কর্মী শহীদ সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার কিসামাত গ্রামে ১৯৩৯ সালের পহেলা আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম কুরআনে হাফেজ মীর মুহাম্মদ হাসান আলী এবং গৃহিণী আমেনা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে আখতার ছিলেন সবার বড়। পাক হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর তাকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর ভাই তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পান।
ধনবাড়ি নবাব ইন্সটিটিউট থেকে তিনি ১৯৫৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক অসমাপ্ত রেখে কাজের সন্ধানে ঢাকা চলে আসেন এবং দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন । তিনি ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যাণ্ড প্যাকেজিং লিমিটেডে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম পাক্ষিক ললনা এবং মাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন সমীপেষু।
ইত্তেফাকে যোগদানের পর একসময় তিনি ইত্তেফাক ছেড়ে সেই সময়ের রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা এলান এ যোগ দেন। মুহম্মদ আখতারের তত্বাবধানে এলান পত্রিকা নতুন জীবন লাভ করে। প্রকাশনা ও সংস্কৃতি জগতের সাথে তার সংযোগ ও কর্মকাণ্ড ক্রমশ নিবিড় হতে থাকে এবং পাকিস্তানি শোষণের চিত্রটিও ক্রমশ তাঁর কাছে স্পষ্ট হতে থাকে । ফলে দেশের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততাও বাড়তে থাকে । একসময় তিনি সরকারী চাকরি ছেড়ে ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যাণ্ড প্যাকেজিং লিমিটেডে ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। তার ব্যবস্থাপনায় এখান থেকেই এ দেশের প্রথম পাক্ষিক ম্যাগাজিন ললনা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন সমীপেষু প্রকাশ করেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ তারিখে মুহাম্মদ আখতারের নামে ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে।
মুহম্মদ আখতার ৪২/৪৩ পুরানা পল্টনে বাস করতেন। তার বাসায় ছিল প্রগতিশীল সহকর্মীদের অবাধ যাতায়াত । স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার । পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার ইতিহাস তাকে সবসময় পীড়িত করতো। স্বাধীনতার পক্ষে তার স্পষ্ট ভাষণ অনেককে বিব্রত করতো, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনে তাঁর বাসায় আসতেন । অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি ভারতে যাবার পথ চিনিয়ে দিয়েছিলেন। মুহম্মদ আখতারের বাসার পাশেই ছিল জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটি যা পৃথিবীর অফিস নামে পরিচিত ছিল । পৃথিবী নামে স্বাধীনতা বিরোধী একটি পত্রিকা এই অফিস থেকে প্রকাশিত হত । এই অফিস থেকেই মুহম্মদ আখতারের গতিবিধির খবর রাখা হত । এই বিষয়টি তিনি বুঝতে পারলেও তাঁর বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসেননি । ফলে তিনি রাজাকার আলবদরদের টার্গেটে পরিণত হন।
মুহাম্মদ আখতারের ছোট ভাই মোহাম্মদ আশরাফ বলেছেন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর (১৪ ডিসেম্বর সাংবাদিক মো মুফাজ্জেল এর মতে) পাকিস্তান বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীর আলবদর বাহিনী মুহম্মদ আখতার এস এ মান্নান (লাডু) সাংবাদিক আবু মুফাজ্জাল কে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে চোখ বেঁধে আল বদর বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আশরাফ বন্ধুদের নিয়ে রায়ের বাজার বধ্য ভূমিতে যান এবং মুহাম্মদ আখতারের বিকৃত মৃতদেহটি দেখতে পান - যার অর্ধেক মাটির নিচে চাপা ছিল। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল । লাশটি উঠিয়ে আনা সম্ভব হয়নি তাই ওখানেই দাফন করা হয়।
# বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক (গ্রন্থটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস।
কারিগরি সহায়তায়: