বাংলাদেশের সাতক্ষীরার সাতানি গ্রামে ১৯২১ সালের ২৩ মার্চ সাংবাদিক আবু তালেব জন্মগ্রহণ করেন। খন্দকার আব্দুর রউফ এবং রোকেয়া খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে আবু তালেব ছিলেন সবার বড়। দৈনিক আজাদের সহ-সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতার পথচলা শুরু। পরবর্তীতে তিনি সংবাদে যোগদান করেন এবং ইত্তেফাকের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইনসাফ , দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক মর্নিং নিউজ, দৈনিক পয়গাম এবং দৈনিক ইত্তেহাদেও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। বেতার সাংবাদিক হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আবু তালেব কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন।
১৯৪৪ সালে সাফল্যের সাথে তিনি সাতক্ষীরার পিএন হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কলকাতার রিপন কলেজ থেকে। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিকম পাস করেন এবং ১৯৫৬ সালে এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
আবু তালেব কাজ শুরু করেন দৈনিক আজাদের সহ-সম্পাদক হিসেবে। এখানে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। সংবাদেও তিনি প্রায় ৫ বছর সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন। এই সময় দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি লুব্ধক ছদ্মনামে নিয়মিত কলাম লিখতেন । খোশনবিশ ছদ্দনামেও “দে গরুর গা ধুইয়ে” শিরোনামেও কলাম লিখতেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে ফাতেমা জিন্নাহ বনাম আইয়ুব খানের ভোটযুদ্ধের সময় বাউণ্ডুলে ছদ্মনামে ভোটরঙ্গ শিরোনামে কলাম লিখে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। দৈনিক আওয়াজে নিয়মিত কলাম লিখতেন আবু তালেব। কাগজের মানুষ শিরোনামে প্রকাশিত এই কলামটি ছিল সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে । সাংবাদিকতা পেশার নানান অভিজ্ঞতা , বিভিন্ন ধরনের দুর্বিপাক, সীমাবদ্ধতা , দুর্বলতার বিষয়গুলো সরসভাবে উপস্থাপিত হতো এই ধারাবাহিক কলামে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি ইস্রাফিল শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করতেন। পরবর্তীতে সাময়িকী ও প্রত্যয় শিরোনামে দুটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন । ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান দুটি টানা প্রচারিত হয়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সাংবাদিকতা পেশাকে আলোকিত করে রেখেছিলেন সাংবাদিক ত্রয়ী সিরাজুদ্দিন হোসেন, খোন্দকার আবু তালেব ও মোহাম্মদ তোহা খান । শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এই ত্রয়ী ছিলেন অবিচ্ছিন্ন। এদের বিচ্ছেদ ঘটেছে ১৯৭১ সালে । স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্নে খোন্দকার আবু তালেব শহীদ হন। আপোষহীন সাংবাদিক নেতা ছিলেন আবু তালেব। বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্ম ও বিকাশের জন্য যাদের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে আছে, আবু তালেব তাঁদেরই একজন। ১৯৬১-৬২ সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সমর্পিত এই নিষ্ঠাবান ও সাহসী মানুষটি বরাবর সংগ্রাম করে গেছেন সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য । সাংবাদিক- সহকর্মীদের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা। শুধু সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবেই নয় সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় আইনজীবী হিসেবেও অনেকবার কোর্টে দাঁড়িয়েছেন তিনি ।
রাজনীতি সচেতন এই দেশপ্রেমিক মানুষটি সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক আদর্শের সমর্থক ছিলেন তিনি । স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন নীরব কর্মী । ছয়দফা আন্দোলনেও এমনিভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। ছয়দফা প্রণীত হয়েছিল ইংরেজিতে। তিনিই তা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং প্রথম প্রকাশ করেছিলেন সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায়। ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অনুবাদও করেছিলেন তিনি।
# বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক (গ্রন্থটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)