শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা কায়সার ১৯২৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ এবং সায়েদা সুফিয়া খাতুনের সন্তান আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার শুরু শহীদুল্লার। ১৯৫৮ সালে তিনি দৈনিক সংবাদের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। শহীদুল্লা কায়সার ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেনএবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে স্নাতক শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ভর্তি হলেও তা শেষ করতে পারেননি।
তিনি মনে করতেন মানুষের চূড়ান্ত মুক্তিপথের দরজা খুলে দিতে পারে মার্কসবাদ । এই পথে চলার অপরাধে তিনি তৎকালীন সরকারের চোখে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং বারবার কারাপ্রাচীরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রেরিত হয়ে অশেষ দুঃখ কষ্ট ভোগ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং সরাসরি কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের মার্চে সরকার কম্যুনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে। দলের নেতাকর্মীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সার প্রকাশ্যে চলাফেরা করতেন। ১৯৫১ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ধর্মঘটে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে শান্তিপূর্ণ মিছিলের অগ্রভাগ থেকে তিনি শ্লোগান দিতে থাকেন। কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। নিষিদ্ধ কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী হবার কারণে ১৯৫২ সালের ৩রা জুন ঢাকার মোগলটুলীর বাসা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কারাবন্দী অবস্থাতেও তিনি পার্টির কাজ চালিয়ে গেছেন বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে। ১৯৫২-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৫৫ সালে মাস খানেকের জন্য মুক্তি পেলেও আবারো কারারুদ্ধ হন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। মাওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর সাংবাদিক জীবন। ১৯৫৮ সালে সংবাদের সহকারী সম্পাদক দিসেবে যোগ দেন। নিজের কর্ম দক্ষতার গুণে তিনি এই পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সংবাদে কাজ করার সুবাদে তিনি যেমন মতাদর্শ প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন তেমনি লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের রোষানল থেকে মুক্তি পাননি । ১৯৫৮সালের ১৪ই অক্টোবর পাকিস্তান সরকার আবারও তাঁকে গ্রেফতার করে। মুক্তি পান ১৯৬২ সালে।
সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন সৎ ও নির্ভীক । সংবাদে তিনি দেশপ্রেমিক ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা এবং বিশ্বকর্মা ছদ্মনামে বিচিত্র কথা এই দুটি কলাম লিখতেন। রাজনৈতিক পরিক্রমায় সমসাময়িক রাজনৈতিক ইস্যু এবং বিচিত্র কথায় সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম , ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস, জ্ঞানবিজ্ঞানের নানান দিক থাকতো । কলাম ২টি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সংবাদ এর সম্পাদক জহুর হোসাইন চৌধুরী নিজেই বলতেন "কেবল নামেই আমি সম্পাদক। পত্রিকার আসল দায়দায়িত্ব শহীদুল্লাহ কায়সারই পালন করতেন"।
দেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব, প্রবন্ধকার , গবেষক, প্রকাশক , মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন "তাঁকে যখন চিনতাম তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা। কোন অনুষ্ঠানে সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথি হিসেবে, রাজপথে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরোভাবে দেখেছি। ওনার সামনে সরাসরি যাবার বা কথা বলার যোগ্যতা বোধকরি তখন আমাদের ছিলনা। আমরা দ্বিধায় ভুগতাম। যদিও আমি জড়িত ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই । আমরা মোহিত ছিলাম ওনার ব্যাক্তিত্ব আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে" ।
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল শহীদুল্লা কায়সারের বিচরণ । তাঁর অন্যতম সেরা সৃষ্টি তার জেল জীবনের লেখা সারেং বউ (১৯৬১) উপন্যাস যেটা পরবর্তীতে সিনেমা হিসেবে দর্শকনন্দিত হয় এবং সংশপ্তক, দিগন্তে ফুলের আগুন (১৯৬১) ও কুসুমের কান্না । ১৯৫৯ সালে লেখেন উপন্যাস কৃষ্ণচূড়া মেঘ। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে একই ছবির দুই পিঠ, অনিরুদ্ধা এবং অন্যান্য অনুগল্প। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই রাজবন্দীর রোজনামচা যেটা ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ কাহিনী পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ, ৮৩টি নিবন্ধ নিয়ে রচিত রাজনৈতিক পরিক্রমা, কাব্যগ্রন্থ চারিদিকে ফুলের মেলা, নাটক যাদু-ই-হালুয়াএবং কবে পহাবে বিভাবরী ১৯৭১ সালে তাঁর লেখা শেষ উপন্যাস। এবং তিমির বলয়ের মত অনেক কালজয়ী লেখা তাঁর আছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে লাভ করেন একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ১৯৯৮ সালে লাভ করেন স্বাধীনতা পুরস্কার ((মরণোত্তর)। নন্দিত শিল্পী এবং তারকা শমী কায়সার এবং ব্যাঙ্কার অমি কায়সার শহীদুল্লাহ কায়সার এবং পান্না কায়সার দম্পতির সন্তান। শহীদুল্লাহ কায়সার এর আট ভাইবোনের মধ্যে জহির রায়হান ছিলেন দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা । ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী শহীদুল্লা কায়সারকে তার কয়েতটুলির বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং আজ অব্দি তাঁর কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
# বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক (গ্রন্থটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস।
কারিগরি সহায়তায়: